- 21 Dec 2025
- Md. Joynal Abdin
- Knowledge Center, Research Articles
- Comments: 0
ব্রাজিল–বাংলাদেশ বাণিজ্য চুক্তি ও শুল্ক কাঠামো
মোঃ জয়নাল আব্দীন
প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট বাংলাদেশ (T&IB)
নির্বাহী পরিচালক, অনলাইন ট্রেনিং একাডেমি (OTA)
মহাসচিব, ব্রাজিল–বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (BBCCI)
বাংলাদেশ এবং ব্রাজিল দুটি উদীয়মান অর্থনীতি, যারা ভৌগোলিকভাবে দূরবর্তী হলেও অর্থনৈতিক পরিপূরকতার কারণে ক্রমশ একে অপরের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদারে পরিণত হচ্ছে। ১৯৭২ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘদিন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সীমিত থাকলেও সাম্প্রতিক এক দশকে এই সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে গতিশীল হয়েছে।
বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী উৎপাদনভিত্তিক অর্থনীতি এবং ব্রাজিলের কৃষিপণ্য ও কাঁচামালনির্ভর শক্তিশালী সরবরাহ কাঠামো এই দুইয়ের সমন্বয় দক্ষিণ দক্ষিণ সহযোগিতার একটি বাস্তব উদাহরণ। তবে বিদ্যমান শুল্ক বাধা, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (FTA) অনুপস্থিতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সীমাবদ্ধতা এই সম্ভাবনাকে এখনও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হতে দিচ্ছে না।
এই প্রবন্ধে ব্রাজিল–বাংলাদেশ বাণিজ্য নীতির বর্তমান অবস্থা, শুল্ক কাঠামো, বিদ্যমান ও সম্ভাব্য PTA/FTA, বাণিজ্য পরিসংখ্যান এবং ভবিষ্যৎ চুক্তির দিকনির্দেশনা বিশদভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে যা সচেতন বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হবে।
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্কের প্রেক্ষাপট ও বিবর্তন
বাংলাদেশ–ব্রাজিল বাণিজ্য সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই অসম ভারসাম্যের মধ্যে ছিল। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক (RMG), অথচ ব্রাজিলের বাজারে এই পণ্যের ওপর দীর্ঘদিন ধরে সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত আমদানি শুল্ক আরোপিত ছিল। ফলে প্রতিযোগিতামূলক মূল্য থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশি পোশাক ব্রাজিলীয় বাজারে পর্যাপ্ত প্রবেশাধিকার পায়নি।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্রাজিল থেকে বিপুল পরিমাণে কাঁচামাল ও খাদ্যপণ্য আমদানি করে আসছে বিশেষত কাঁচা তুলা, চিনি, সয়াবিন ও ভোজ্যতেল। এই কারণে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ঘাটতি ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের বিপক্ষে রয়ে গেছে।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিক সফর, যৌথ চেম্বার কার্যক্রম এবং ব্যবসায়িক প্রতিনিধিদল বিনিময়ের ফলে এই সম্পর্ক একটি কাঠামোগত রূপ নিতে শুরু করেছে।
বর্তমান বাণিজ্য নীতি ও চুক্তির অবস্থা
বর্তমানে বাংলাদেশ ও ব্রাজিলের মধ্যে কোনো দ্বিপাক্ষিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA) বা পছন্দনীয় বাণিজ্য চুক্তি (PTA) কার্যকর নেই। উভয় দেশের বাণিজ্য বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (WTO) Most Favoured Nation (MFN) নীতির আওতায় পরিচালিত হয়।
বাংলাদেশ লাতিন আমেরিকার কোনো দেশের সাথেই এখনো আনুষ্ঠানিক FTA বা PTA সম্পাদন করেনি। এর ফলে চীন, ভিয়েতনাম বা ভারত যেসব সুবিধা নিয়ে এই অঞ্চলে প্রবেশ করছে, বাংলাদেশ সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
শুল্ক কাঠামো ও বাজারে প্রবেশের বাস্তবতা
ব্রাজিলের শুল্ক কাঠামো:
ব্রাজিল MERCOSUR কাস্টমস ইউনিয়নের সদস্য হওয়ায় তাদের Common External Tariff তুলনামূলকভাবে উচ্চ। বিশেষ করে টেক্সটাইল ও পোশাক খাতে সর্বোচ্চ ৩৫% শুল্ক আরোপিত, যা বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাতের জন্য সবচেয়ে বড় বাধা।
বাংলাদেশের শুল্ক কাঠামো:
বাংলাদেশ সাধারণত ভোক্তা পণ্যে উচ্চ শুল্ক আরোপ করলেও শিল্প কাঁচামালের ওপর তুলনামূলকভাবে কম শুল্ক আরোপ করে। ফলে ব্রাজিল থেকে আমদানি করা কাঁচা তুলা প্রায় শুল্কমুক্ত, চিনি ও সয়াবিনের ওপরও সময়ে সময়ে শুল্ক হ্রাস করা হয়েছে বিশেষত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে।
এই নীতিগত পার্থক্যের ফলে ব্রাজিলের রপ্তানি সহজ হলেও বাংলাদেশের রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিসংখ্যান ও পণ্যের কাঠামো
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ বছরে প্রায় ২.৫–৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। তবে এর মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি মাত্র ১৫০–২০০ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে সীমাবদ্ধ, যেখানে আমদানি ২.৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
বাংলাদেশের রপ্তানি (প্রধানত):
তৈরি পোশাক, নিট ও ওভেন অ্যাপারেল, সীমিত পরিসরে ওষুধ, প্লাস্টিক পণ্য, সিরামিক ও জুটজাত পণ্য।
বাংলাদেশের আমদানি (প্রধানত):
চিনি, কাঁচা তুলা, সয়াবিন, ভোজ্যতেল, গম ও অন্যান্য কৃষিপণ্য। এই কাঠামো স্পষ্টভাবে একটি আমদানিনির্ভর ও ঘাটতিপূর্ণ বাণিজ্য চিত্র তুলে ধরে।
MERCOSUR–বাংলাদেশ PTA ও সম্ভাব্য FTA
বাংলাদেশ সম্প্রতি দক্ষিণ আমেরিকার MERCOSUR ব্লকের সাথে একটি Preferential Trade Agreement (PTA) করার প্রস্তাব দিয়েছে। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা এই প্রস্তাবকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে এবং প্রাথমিক আলোচনায় সম্মতি দিয়েছে।
এই PTA সম্ভাব্যভাবে নির্বাচিত কিছু পণ্যের ওপর শুল্ক হ্রাস বা কোটা সুবিধা প্রদান করবে। বাংলাদেশের লক্ষ্য থাকবে পোশাক, ওষুধ ও হালকা প্রকৌশল পণ্য; আর MERCOSUR পক্ষের আগ্রহ থাকবে কৃষিপণ্য ও শিল্প কাঁচামালে।
এছাড়া বাংলাদেশ ও ব্রাজিল একটি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা কাঠামো চুক্তি (Framework Agreement) নিয়েও আলোচনা করছে, যা ভবিষ্যতে পূর্ণাঙ্গ FTA-এর ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে।
বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সুবিধা সম্প্রসারণ
শুধু শুল্ক হ্রাস নয়, উভয় দেশ বাণিজ্য সহজীকরণ, এলসি প্রক্রিয়া সরলীকরণ, সরাসরি শিপিং রুট উন্নয়ন এবং পারস্পরিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির ওপরও গুরুত্ব দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্রাজিলীয় বিনিয়োগ আহ্বান করছে টেক্সটাইল, জ্বালানি, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ ও অবকাঠামো খাতে। অপরদিকে ব্রাজিল বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প, আইটি ও উৎপাদন খাতে সম্ভাবনা দেখছে।
উপসংহার:
বাংলাদেশ–ব্রাজিল বাণিজ্য সম্পর্ক এখন একটি রূপান্তরকাল অতিক্রম করছে। দীর্ঘদিনের শুল্ক বাধা ও চুক্তির অভাব সত্ত্বেও সাম্প্রতিক কূটনৈতিক ও নীতিগত অগ্রগতি ভবিষ্যতের জন্য আশাব্যঞ্জক। যদি PTA বা পর্যায়ক্রমে FTA বাস্তবায়িত হয়, তবে বাংলাদেশের জন্য লাতিন আমেরিকার বাজারে প্রবেশের নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে এবং ব্রাজিলের জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় একটি শক্তিশালী বাণিজ্যিক অংশীদার তৈরি হবে। বিনিয়োগকারী ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পেশাজীবীদের জন্য এটি একটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ উদীয়মান করিডোর, যেখানে আগাম প্রস্তুতি ও বাজার বোঝাপড়া ভবিষ্যৎ সাফল্যের চাবিকাঠি হতে পারে।